শুক্রবার, ২২ অগাস্ট ২০২৫, ০৬:৫৯ পূর্বাহ্ন

কালীগঞ্জে চলছে চিত্রা নদী দখলের মহোৎসব

ঝিনাইদহ প্রতিনিধি॥

নদীর মধ্যে বড় বড় পুকুর। পুকুর পাড়ে লাগানো হয়েছে বনজ গাছ। গাছগুলো এতোটা বড় হয়ে উঠেছে যে নদীকেই আড়াল করে ফেলেছে। একপাশ থেকে আরেক পাশ দেখা যায় না। এই নদীর জায়গা দখল করেই নির্মান করা হয়েছে অসংখ্য ভবন। বসানো হয়েছে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। এখনও চলছে এই দখল প্রক্রিয়া। যেন কারো কিছুই বলারও নেই, করারও নেই।

এভাবে দখলের পর দখল করায় সংকুচিত হয়ে গেছে দক্ষিনাঞ্চলের ঐতিহ্যবাহি চিত্রা নদীটি। দখলদাররা আস্তে আস্তে দখল করে নদীটিকে প্রায় গ্রাস করে ফেলেছে। একটি সময়ে যে নদীতে লঞ্চ-স্টিমার চলতো সেই নদী এখন খালে পরিনত হয়েছে। দখলদাররা প্রভাবশালী হওয়ায় কেউ প্রতিবাদ করতে সাহস পাচ্ছে না। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানসহ নানা অজুহাতে এই দখল অব্যাহত রয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড ঝিনাইদহের নির্বাহী প্রকৌশলীর দপ্তরে খোজ নিয়ে দখলের সঠিক হিসাব পাওয়া যায় নি। সংশ্লিষ্ট বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ সারোয়ার জাহান ওরফে সুজন জানান, সম্প্রতি তারা দখলদারদের একটি তালিকা তৈরী করেছেন। সেখানে চিত্রা নদীতে কয়েকটি পুকুর আছে উল্লেখ রয়েছে। তালিকায় দেখা গেছে জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার সিংদহ গ্রাম এলাকায় ৮ দখলদার এর দখলে ৮ টি পুকুর রয়েছে।

সরেজমিনে নদী এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, কালীগঞ্জের চাঁচড়া এলাকা থেকে শালিখা পর্যন্ত দীর্ঘ প্রায় ৫ কিঃ মিঃ লম্বা নদীর দুই পাড় চলেছে এই দখলের প্রতিযোগিতা। এখানে নদীর জায়গায় পুকুর কেটে মাছ চাষ করা হচ্ছে। নদী ভরাট করে নার্সারী প্রতিষ্ঠাও করেছে দখলদাররা। মার্কেট, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়েছে। অত্যান্ত পরিকল্পিত ভাবে পাঁকা ঘরগুলো নির্মাণ করা হয়েছে। এখনও কিছু কিছু স্থানে নির্মান কাজ চলছে। দখলের কারনে নদীটি খালে পরিনত হয়েছে। অথচ একটি সময়ে এই নদীতে লঞ্চ-স্টিমার চলতো। নদীতে চলাচলকারী নৌকায় মালামাল আনা-নেওয়া হতো। নদীর ঘাটকে ঘিরে গড়ে ওঠে কালীগঞ্জ শহরটি।

ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ শহরের মেইন বাসষ্ট্যান্ড সংলগ্ন ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের পশ্চিম পাশে চিত্রা নদীর ব্রীজ সংলগ্ন নির্মান শুরু হয়েছিল একটি বিশাল পাঁকা ভবন। কিন্তু সংবাদপত্রে লেখলেখির কারনে বন্ধ আছে। এরই কিছুটা পশ্চিমে শিবনগর গ্রামের নিচে জনৈক মুক্তার হোসেন নদীর জায়গায় ঘর তৈরী করে মুরগীর ফার্ম করেছেন। শহরের মধ্যে নদীর উপর থাকা সেতুটির (পুরাতন সেতু) দুই পাশে মার্কেট গড়ে উঠেছে। সেতুর পশ্চিমে নদীর দুই পাড়ে যেভাবে বড় বড় পাঁকা ভবন তৈরী হয়েছে, এখন দেখে বোঝার উপায় নেই এটা নদী। নদীটি খালে পরিনত হয়েছে। সেতুর পূর্ব পাশেও দুই পাড়ে অসংখ্য পাঁকা ভবন। এক শ্রেণীর লোকজন নানা কাগজপত্র দেখিয়ে এই সকল জায়গাটি তাদের দাবি করে আসছেন।
কিন্তু প্রবীন ব্যক্তিদের ভাষায় এগুলো সবই এক সময়ে নদীই ছিল। শহরের কালীবাড়িটিও কিছু অংশ নেমে গেছে নদীর মধ্যে। সেখানেও দখল হয়েছে নদীর জায়গা। হেলাই হাসপাতালের নিচে নদীর মধ্যে বিশাল বড় পুকুর কাটা হয়েছে। এই পুকুরের পাড়ে বিশাল বিশাল গাছ রয়েছে। যেগুলো নদীর পানির গতিপথই নয়, গোটা নদীটিই আড়াল করে দিয়েছে। নিশ্চিন্তপুর এলাকার নদীর মধ্যে ঈদগাহ নির্মান করা হয়েছে। এভাবে চিত্রা নদীর কালীগঞ্জ অংশের বেশিরভাগ জায়গা দখল করে নিয়েছেন দখলদাররা।

সরেজমিনে খোজ নিতে গিয়ে আরো জানা গেছে, শুধু দখল নয়, নদীতে নানা ধরনের ময়লা ফেলে ভরাট করা হচ্ছে। ক্লিনিকের বর্জ্য, শহরের ময়লা ফেলে পানি দুষণ করা হচ্ছে। একাধিক ব্যক্তি জানান, প্রায়ই এক শ্রেণীর মানুষ বস্তায় ভরে ময়লা এনে সেতুর উপর থেকে নিচে পানিতে ফেলেন। এই বস্তায় নানা ময়লা থাকে। অনেক ক্ষেত্রে কুকুর-বিড়াল মারা যাওয়ার পরও বস্তায় ভরে নদীতে ফেলা হচ্ছে। এতে নদীর পানি দুষিত হচ্ছে।
শহরের সিনেমাহল এলাকার বাসিন্দা মোশারফ হোসেন জানান, প্রায়ই তাদের চোখে পড়ে নদীতে ময়লা ফেলা হচ্ছে। প্রতিবাদ করলে উল্টো খারাপ আচরন করেন দখলদাররা।

এ সকল বিষয়ে কথা হয় নদীর জায়গায় মুরগীর ফার্ম নির্মানের সঙ্গে যুক্ত মুক্তার হোসেনের সঙ্গে। তিনি জানান, বেশ কয়েকবছর পূর্বে তিনি ঘরটি নির্মান করেছেন। সেই সময়ে বাঁধা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু পরে সরকারি লোকজন নদীর সীমানা মেপে তাকে ঘরটি নির্মানের অনুমতি দিয়েছেন। লিখিত অনুমতি আছে কিনা জানতে চাইলে মৌখিক অনুমতি পেয়েছেন বলে জানান। তাছাড়া সম্প্রতি তিনি নতুন করে কাজ করেননি বলে জানিয়েছেন। ঝড়ে কিছুটা ক্ষতি হলে সেটা মেরামত করেছেন বলে জানিয়েছেন। নিশ্চিন্তপুর এলাকার নিচে নদীর মাঝে পুকুর রয়েছে তারিকুর রহমানের। তিনি জানান, নদীর উপর তাদের জমি রয়েছে। সেখানে পাড় ঘেষে পুকুর তৈরী করেছেন। নদীর মধ্যে পুকুরের অংশ যায়নি বলে জানান তিনি। হেলাই গ্রামের একাধিক ব্যক্তি জানান, তাদের গ্রামের নিচে নদীর অপরপাড় দখল করে ঈদগাহ নির্মান করা হয়েছে। যে স্থানে মাত্র ১৫ থেকে ২০ বছর পূর্বেও নদীর শ্রোত ছিল।

এ বিষয়ে কালীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সুবর্ণা রাণী সাহা জানান, এগুলো উচ্ছেদের জন্য গণজাগরন প্রয়োজন। যারা এভাবে দখল করছে তাদের বিরুদ্ধে শুধু আইন দিয়ে কাজ হবে না। তিনি বলেন, নদীর মধ্যে ভবন, পুকুর এগুলোর বিষয়ে খোঁজ নিয়ে ব্যবস্থা নিবেন।

সংবাদটি শেয়ার করুন

© All rights reserved © 2024  Ekusharkantho.com
Technical Helped by Curlhost.com